আন্তর্জাতিক
লাদাখ কেন বিক্ষোভে ফুঁসছে

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে লেহে বিজেপি সদর দফতরের বাইরে লাদাখকে রাজ্য করার দাবিতে প্রতিবাদরতদের এবং পুলিশের মধ্যে সংঘটিত সহিংস সংঘর্ষের পরে একটি যানবাহনের পোড়া ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। | ছবি: PTI
বুধবার ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে তরুণদের বিক্ষোভ সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয়, দুদিন পর ‘লেহ এপেক্স বডির’ (একটি স্বতন্ত্র ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন) নেতারা যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, সতর্ক করে বলেছিলেন জনগণের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে।
তাদের দাবিটি কেবল স্বায়ত্ত্বশাসিত রাজ্যের মর্জাদার বিষয় নয়, তাদের দাবির বিষয়গুলো আরো বিস্তৃত যা গোত্রভিত্তীক এই অঞ্চলের আদি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করবে। লাদাখের প্রধান সম্প্রদায় বৌদ্ধ ও মুসলিমরা একসাথে এই আন্দোলন করছে।
সোমবার এলএবি ঘোষণা দিয়েছে তাদের নেতৃবৃন্দ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন ধর্মঘট থামাবে না। ১০ ই সেপ্টেম্বর থেকে এলএবি এর নেতৃবৃন্দ ৩৫ দিনব্যাপি অনশন ধর্মঘট শুরু করে ছিলো।
প্রসিদ্ধ আন্দোলনকারী সোনাম ওয়াংচুকের অনশন ধর্মঘট একই সাথে ছিলো, যদিও তিনি সহিংস আন্দোলনকে পাগলামী বলে নিন্দা জানিয়েছেন এবং এবং ঘৃণাভরে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এলএবি কার্গিল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সে-এর সঙ্গে মিলিত ভাবে তাদের দাবিগুলো নিয়ে স্বরষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের সাথে সংলাপ চলছিলো, যার জন্য তারা গত চার বছর আন্দোলন করে চলেছে।
কৌশলগত ভাবে লাদাখ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যেহেতু এর সীমান্ত চীন-এর সাথে এবং বহু বছর ধরে লাদাখের চীন সীমান্তে অস্থিরতা বিরাজমান।
লেহ বিক্ষোভের পেছনে তাৎক্ষণিক দাবি গুলো কি ছিলো?
- এলএবি যা চেয়েছিলো: এলএবির যুব শাখা বুধবার একটা গণআন্দোলনের ডাক দিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তাৎক্ষণিক বৈঠকের দাবি করেছিল, কারণ তাদের নেতৃবৃন্দরা ১০ই সেপ্টেম্বর থেকে অনশন ধর্মঘট পালন করছিল।
- লাদাখের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় যা ঠিক করেছিল: কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন চালু হওয়ার পর থেকে মিনিস্ট্রি অব হোম অ্যাফেয়ার্স লাদাখের তদারকি করে। তারপর তারা ঘোষণা করে যে পরবর্তী আলোচনা ৬ অক্টোবর হবে। সর্বশেষ বৈঠক মে মাসে হয়, সাম্প্রতিক সময়ের আলোচনা ২০২৪ সাল থেকে চলে আসছে।
- এই সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নেয়নি: কিন্তু এলএবি-এর সদস্যরা দেখল যে অক্টোবরের সময়টি তাদের সাথে আলোচনা না করে ঠিক করা হয়েছে, যখন কিনা তাদের লোকজন অনশন কর্মসূচি পালন করছে।
একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এলএবির সহকারি চেয়ারম্যান চেরিং ডরজে বলেছেন তারা সরকারকে বলেছিল যে একটি সমঝোতায় না আসা পর্যন্ত অনশন কর্মসূচি বন্ধ করা যাবে না। প্রেস ট্রাস্ট ইন্ডিয়ার রিপোর্টে জানা যায় যে ডরজে বলেন,"আমাদের বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ, কিন্তু জনগণ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি যে কোন সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।"
জনগন এটাই মনে করে যে অহিংস আন্দোলনে কিছুই মিলবে না
সোনম ওয়াংচুক সোমবার বলেছিলেন, বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় আনার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আসন্ন হিল কাউন্সিল নির্বাচনের আগে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা উচিত। ওয়াংচুক বলেন, “যদি তারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, তারা লাদাখের জনগনের ভোট দেবে। এতে তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে, আর না হলে কিছুই পাবে না।” তিনি আরও বলেন, মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। “তারা আমাদের বলে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কিছুই পাচ্ছি না। আমরা চাই না, এমন কিছু ঘটুক যা ভারতের জন্য বিব্রতকর,” বলেন ওয়াংচুক।
লেহ-লাদাখ আন্দোলনের প্রধান দাবিগুলো কী?
যদিও এই দাবিগুলো ২০১৯ সালে ‘জম্মু এণ্ড কাশ্মির’ কে ভাগ করে লাদাখকে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ করার পর থেকেই ছিল, যা দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের একটি। এই দাবিগুলোকে কেন্দ্র করেই ২০২৪ সালে তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলনে রূপ নেয়।
জম্মু ও কাশ্মীর-এর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভা রয়েছে এবং ইতিমধ্যেই সেখানে প্রথমবেরের মত নির্বাচিত সরকারও গঠিত হয়েছে। কিন্তু লাদাখ পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা শাসিত হয়।
৩৭০ ধারা এবং জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর লাদাখের জনগন কিছু সুবিধা হারায়, যেমন— স্থানীয় নন এমন লোকদের জন্য জমির মালিকানার নিয়ম শিথিল হওয়া।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি নের্তৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের এই পদক্ষেপের পর থেকে লাদাখের জনতা চার দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে:
১. লাদাখের পূর্ণ রাজ্য মর্যাদা, কারণ কেন্দ্রশাসিত আঞ্চলিক মর্যাদা স্বায়ত্ত্ব শাসন ও সুরক্ষার দাবি পূরণ করেনি।
২. ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে লাদাখকে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে এর আদিবাসী মর্যাদা সুরক্ষিত হয়।
৩. বেকারত্ব মোকাবিলার জন্য লাদাখের আলাদা সরকারি কর্ম কমিশন গঠন।
৪. লাদাখের জন্য দুটি সংসদীয় আসন, বর্তমানে একটি আসন রয়েছে।
ষষ্ঠ তফসিলের বিষয়টি কী?
মিনিস্ট্রি অব হোম অ্যাফেয়ার্স কেবল শেষ দুটি দাবি নিয়ে আলোচনায় রাজি হয়েছিল: আলাদা কর্ম কমিশন এবং একটির বদলে দুটি লোকসভা আসন।
রাজ্য মর্যাদার দাবি নিয়ে পাল্টা যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, লাদাখ এখন ইতিমধ্যেই ইউটি মর্যাদা পেয়েছে, যা তারা জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অংশ থাকাকালে দাবি করত।
কিন্তু ষষ্ঠ তফসিলের দাবি আলাদা গুরুত্ব বহন করে।
ষষ্ঠ তফসিল আসামের, মেঘালয়ের, মিজোরামের ও ত্রিপুরার মতো রাজ্যের গোত্র ভিত্তীক এলাকাগুলোকে বেশি স্বায়ত্বশাসন দেয়।
অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (ADC) জমির ব্যবহার, উত্তরাধিকার আইন, সামাজিক রীতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। ADC আইন প্রণয়ন, নির্বাহী ও কর সংগ্রহ ও স্থানীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে পারার মত আর্থিক ক্ষমতা রাখে।
ADC আইন প্রণয়ন করতে পারে, যা রাজ্যের আইনের ওপরে প্রাধান্য পায়, তবে রাজ্যের গভর্নরের অনুমোদন লাগে।
বর্তমানে লাদাখ অটোনোমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (LAHDC)-এর কেবল জেলা পর্যায়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়নের নির্বাহী ক্ষমতা আছে।
বেকারত্ব প্রধান সমস্যা
বেকারত্ব ও সরকারি নিয়োগের অবহেলা তরুণদের ক্ষুব্ধ করছে। তাই আলাদা কর্ম কমিশনের দাবি উঠেছে।
এক সাম্প্রতিক সরকারি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, লাদাখের ২৬.৫% স্নাতক বেকার।
সারা দেশের হার ১৩.৪%।
সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত আঞ্চলের মধ্যে আন্দামান ও নিকোবারে সর্বোচ্চ বেকারত্ব ৩৩%, এরপরই লাদাখ ২৬.৫%।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার সময় সরকার ক্রমাগত লাদাখিদের জন্য ৯৫% চাকরির কোটা প্রস্তাব করেছিল।
বুধবারের সহিংসতায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কার্গিল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সে নেতা সাজাদ কারগিলি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন:
“লেহ-তে যা ঘটছে তা দুর্ভাগ্যজনক। একসময়ের শান্তিপূর্ণ লাদাখ এখন হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতায় আচ্ছন্ন, সরকারের ব্যর্থ কেন্দ্রশাসিত আঞ্চলিক সিস্টেম বাস্তবায়নে কারণে। এর দায় সরকারের। তারা আলোচনায় ফিরুক, বিচক্ষণ হোক এবং লাদাখের রাজ্য মর্যাদা ও ষষ্ঠ তফসিল বাস্তবায়নের দাবি দ্রুত পূরণ করুক। আমি জনতাকেও অনুরোধ করছি শান্তিপূর্ণ ও নিজের লক্ষ্যে দৃঢ় থাকুন।”
সরকার এই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র ভাবছে, কর্মকর্তারা বলেছেন তরুণদের “ক্যানন ফডার” হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা নেপালের সাম্প্রতিক “জেন জি” আন্দোলনের উল্লেখ করে এটিকে একটি “অশুভ ষড়যন্ত্র” এর প্রমাণ হিসেবে দেখছেন।
সূত্রঃ হিন্দুস্তান টাইমস







