সম্পাদকীয়
রেলে লোকসানের দুষ্টচক্র
রেলে লোকসানের দুষ্টচক্র, সঠিক ব্যবস্থাপনায় লাভজনক করতে হবে

সংগৃহীত
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেল বরাবরই এক অদ্ভুত ধাঁধার মতো। প্রতিটি উৎসবে, ছুটির দিনে, এমনকি সাধারণ সময়েও ট্রেনের টিকিট যাত্রীদের কাছে যেন সোনার হরিণ। দ্রুত যাতায়াতের জন্য যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে, ইঞ্জিনে, এমনকি দুই বগির সংযোগস্থলে পর্যন্ত জায়গা করে নেন। অথচ রেলের নিজস্ব পরিসংখ্যান বলছে, তাদের ১৫ শতাংশ টিকিট অবিক্রীত থাকে এবং প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। বৃহস্পতিবার যুগান্তরের খবরে প্রকাশ-ট্রেনে যাত্রীদের একটি বড় অংশ অবৈধভাবে ভ্রমণ করলেও বিনা টিকিটধারীদের নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ সফল হতে পারছে না। রেলের অভিযোগ, এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলেই টিকিট পরিদর্শকরা লাঞ্ছনা ও হুমকির শিকার হন। এমনকি স্টেশন ও ট্রেন ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। প্রশ্ন হচ্ছে, রেলের এই লোকসানের পেছনে কি কেবলই বিনাটিকিটে ভ্রমণকারী যাত্রী দায়ী, নাকি এর মূল কারণ আরও গভীরে?
আমরা দেখছি, রেলের লোকসানের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যাত্রী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ। এছাড়া অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিও যে একটি বড় কারণ, তা বলাই বাহুল্য। গত কয়েক বছরে রেলের অবকাঠামোর আশানুরূপ উন্নতিও হয়নি। যদিও সদিচ্ছা থাকলে বর্তমান অবকাঠামো ও ইঞ্জিন-কোচ দিয়ে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটিয়ে এ সংস্থার আয় কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। সাবেক এক মহাপরিচালক তো স্বীকারই করে বলেছেন, ভ্রমণকারী যাত্রীদের টিকিট নিশ্চিত করা গেলে প্রতিদিন এ খাত থেকে কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। একথা ঠিক, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া নানা সিদ্ধান্ত রেলের এই লোকসানের দুষ্টচক্রকে আরও জটিল করে তুলেছে।
পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে রেলের ব্যর্থতা লোকসানের আরও একটি বড় কারণ। একসময় সিমেন্ট, সার, পাট, খাদ্যপণ্য পরিবহণে রেলের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে মাত্র ২-৪ শতাংশ মালামাল পরিবহণ করা হয়। পণ্য পরিবহণের বিশাল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রেল কর্তৃপক্ষ কেন কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো নিচ্ছে না, এ প্রশ্নেরও সদুত্তর জরুরি। যেখানে সড়কপথে পণ্য পরিবহণের খরচ বেশি এবং যানজট নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই রেলওয়ের এ সুযোগ কাজে লাগানোর কথা। যদি রেল কর্তৃপক্ষ মালবাহী ট্রেনগুলোকেও আধুনিক ও লাভজনক উপায়ে পরিচালনা করতে পারে, তবে লোকসান অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করি আমরা।
রেলের লোকসান কমাতে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। টিকিটবিহীন যাত্রী নিয়ন্ত্রণ করতে পুনরায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কেবল লাভজনক রুটে পর্যাপ্ত কোচসহ ট্রেন পরিচালনা করা এবং পণ্য পরিবহণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি। সংস্থাটির অপ্রয়োজনীয় ও বাড়তি ব্যয়ও পরিহার করতে হবে। একইসঙ্গে বেদখল হওয়া রেলের হাজার হাজার একর জমি পুনরুদ্ধার করে তা থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগটিও কাজে লাগানো যেতে পারে। লোকসানের এই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে হলে রেলওয়েকে কেবল যাত্রী পরিবহণ নয়, বরং একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। অন্যথায় যাত্রীর ভিড় সত্ত্বেও রেলের লোকসান অব্যাহত থাকবে।




